টৌন জলপাইগুড়িঃ এ-স্পার উ-স্পার

 

 এ-স্পার উ-স্পার

 করলামতি রায়

 

 একটি শহরে পাশাপাশি দুইটি নদী বিছানো থাকে। দুইটি নদীর তিনটি বাঁধ। বাঁধের একপাশের নদীর নাম যদি করলা বাঁ পাশে অবশ্যম্ভাবী তিস্তা। শহরবাসীর তিস্তা নিয়ে, তিস্তার স্পার নিয়ে আবেগ জল হয়ে ভাসে জুবলি পার্কের দিকে। আর করলা নিয়ে এক নিঃসীম উদাসীনতা একা দাঁড়িয়ে থাকে কিং সাহেবের ঘাটের বড় গাছটার ছায়ার হয়ে। 

  নদী দুটো যত পরস্পরের কাছে এসেছে তিনটে বাঁধ দুটো নদীকে বেঁধেছে। জেওয়াইএম-এর বাঁধ, করলা সেতু, নেতাজি স্ট্যাচু, তিস্তা উদ্যান, ডি.এম বাংলো, সার্কিট হাউসের সামনের রাস্তা মিশেছে জুবিলি পার্কের এক নম্বর স্পারের ‘নিউটনের আপেল গাছের’ সামনে। এই অঞ্চল জুড়ে মাত্র দুই বা চার বর্গ কিলোমিটারে টাউন জলপাইগুড়ির এক অন্য শহর, অন্য আকাশ, অন্য ভুবন। শহরের ভেতরে এক আলাদা ভূখণ্ড। শহরবাসীর সমস্ত আবেগ এসে জলের মত জড়ো হয় নদীর পাড়ে আদি ও অনন্ত ধরে।

  একসময় সাহেবদের বাড়ি ঘর ক্লাব অফিসগুলো তৈরি হয় দুই নদীর আশপাশেই, ডিভিশনাল পাণ্ডববর্জিত শহরে। সাবেকি রাজপুরুষরা নিজেদের শহরবাসী থেকে কিছুটা আলাদা রাখতেই চেয়েছিল, সেটাই ইতিহাসের দস্তুর। স্বাধীনতার এত বছর পরেও এই দুটো নদীর মাঝে সাধারণ শহরবাসীর কোনো বাড়ি তৈরি হয় না। ভূমি দফতরের খাতায় কলমে এই দুই নদীর মাঝের জমিটুকু ছায়া কুয়াশা আর বৃষ্টির জন্য সংরক্ষিত! 

 দুটো নদী, দুটো পার্ক (একটা চিলড্রেনস পার্ক অন্যটা জুবলি পার্ক। তিস্তা উদ্যান অনেক পরে হয়েছিল।), কয়েকটা লাল বাংলো আর একটা সীমাহীন নৈশব্দ জড়িয়ে আছে যুগ-যুগান্ত ধরে। মাটির নদী-বাঁধের দুই পারে বৃদ্ধ কালচে বড় গাছগুলো ঝুঁকে পড়ে করলার গায়ে। করলার গায়ের রং গাঢ় সবুজ হয়ে ওঠে। আকাশের ছায়া পড়ে না, শ্যাওলা আর গাছের ছায়া সবুজ-গম্ভীর করে তোলে নদীকে। প্রাচীন গাছের ছায়া বাঁধের পথকে করে মোহনাগামী। বৃষ্টি আসার আগে করলার বাঁধের বড় গাছগুলোতে আশ্রয় নেয় অর্কিডের সংসার। এই টাউনে তিনমাস জুড়ে বর্ষা কিছুটা শীত, বাকি বছর শুধুই ক্যালেন্ডারের ঋতু। শীতকালে পুলিশ লাইন থেকে ভেসে আসত সার্কাসের হাতির ডাক। ইউরোপিয়ান ক্লাব ঘরের গান টাউনবাসী শোনেনি কখনো, ভোরে ঘন্টা পোকার ডাক বা হাওয়ার শব্দ শোনা যায়। কোন মাতাল সাহেবের গল্প অথবা রেসকোর্স থেকে ঘোড়ার খুরের শব্দ যা দ্রুতগামী রাতের দিকে চলে যায় এমন গল্প, ইতিহাস জানে না। এক সময় করলা না কি কিং সাহেবের ঘাটের সামনেই তিস্তায় এসে মিলেছিল, নদীয়া সেরকমটাই জানত। ঠিক যে জায়গায় আজকের জুবিলী পার্ক, ওর বাদাম বেচার জায়গা। তিস্তা মুখ পাল্টে করলার থেকে দূরে চলে যায়, বার্নেশের দিকে। সেই বার্নেশ যেখানে হোগলা পাতার ওপর দিয়ে গাড়ি যেত কিং সাহেবের ঘাট থেকে, বাকিটা নৌকায় পারাপার, আনা কড়ির হিসেব আর বাকিটা লুকিয়ে থাকা বাঘের গল্প। করলার বাঁধে সকালে হাঁটতে মানুসবের দল নদীর ওপারের বাঁধে ফুল চুরির স্বপ্ন দেখে। কুয়াশা বৃষ্টি ছাড়াও শিরশিরে একটা হওয়া ভেসে বেড়ায় বাঁধ জুড়ে ঠিক নদীতে জলে ভেসে থাকা কচুরিপানা আর থার্মোকল। পুটুস ফোটে সারা ঝোপ জঙ্গল জুড়ে। কিশোর বয়সের প্রেম বার্ধক্যে এসে নদীর জল ছোঁয়… জলের দিকে ঝুঁকে পড়া বৃদ্ধ গাছটার মত! 


 

   তিস্তায় বন্যা হলে করলা নদীর ওপর ব্রিজ তৈরি হয়। ব্রিজের পাশে নেতাজি দাঁড়িয়ে থাকেন রুদ্রপলাশ গাছের নিচে। যে গাছে আর্কিডরা নির্ভরতার বাসা বানায়। আই.টি.পি.এ হল থেকে নিলামে ওঠে চা ফুলের গন্ধ। পূর্ত দপ্তরের লাল বাড়ি, ডিএম বাংলো ফরেস্ট আধিকারিকের বাংলো সবাই মিলে চলে যায় চার্চের স্কটিশ চার্চের দিকে বড়দিন উদযাপনে। চলে যায় নদীর স্পারের দিকে মহালয়ার সকালের কাশবনে। শহর এসে নদীর মুখোমুখি হয়। যেখানে শহর প্রেমে পড়ে, প্রেম ভাঙে। বিস্মরণের মেঘে ছেয়ে যায় তিস্তার ধারের আকাশ। এত আনন্দ এত আয়োজন--- শহর ডুবে যায় বৃষ্টি ঝড় জলের ঝাপসা মাঠে। একটু একটু করে ভুলে যায় --- কী যেন, কাকে যেন না ভোলার কথা ছিল! হারিয়ে যাওয়া মুখকে! কত শত ডাকনাম, হাতধরা সম্পর্ক! পার্কের বাঁধানো বেঞ্চে, আদিত্যর চায়ের দোকান বিচারপতি ভবনের অধীনস্ত হয়ে যায়। জুবলি পার্কের ভেতর সেই একুইরিয়ামটার খবর আর কেউ রাখে না। 

জগতের এই আনন্দ উৎসবে যখন তাঁকে মনে রাখার প্রয়োজন ফুরায়। বর্ষায় নদীর জল বাড়ে, মানুষের ভিড় বাড়ে। নদীয়ার বেচাকেনা কিছুটা বেশি হয়। সিমেন্টের সবুজ হলুদ বেঞ্চ এ কোন এক ঋতুতে নির্বিকার কাগজফুল পরে থাকে, যেখানে দুটো নদী এক হয়, যেখানে দুটো বাঁধ এক হয়। কৈশোর সাইকেলে নিয়ে চলে যায় মোহনার দিকে।

 দুটো নদী পাশাপাশি বিছানো থাকে, তিনটে বাঁধ তার গায়ে। গাছেরা নদী উপত্যকায় দাঁড়িয়ে থাকে, বৃষ্টিতে ভেজে কুয়াশা মাখে। শহরের মধ্যে আরেকটি শহর আরেকটা ভূখন্ড রচনা হয় ঔপনিবেশিক কাল থেকে। যে দুই বা চার বা ছয় বর্গ কিলোমিটার নদী, পার, স্পার শহরের মধ্যে থেকেও অন্য পারের শহর যেন। শহর নদীকে দেখে, নদী শহরকে—

 একটা শহরের গল্পের চৌকাঠে দুটো নদী বসে থাকে। সে নদী কিছুই ভোলে না শহরকে, বরং উপচে ভাসিয়ে দেয় স্মৃতির ঘরদোর! ভাসিয়ে দেয় স্মৃতির এ-স্পার উ-স্পার।


ফোটোঃ সৌগত ভট্টাচার্য

   

 সূচিপত্রে যাওয়ার সূত্র

   

 

   

    

 

Comments

Popular posts from this blog

বিশেষ রচনা: শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়-এর 'বাজার সফর সমগ্র'

ধারাবাহিক উপন্যাস

ধারাবাহিক রচনা: ছবিতে নারী এবং নারীর ছবি