টাউন বাজারৎ
বাজারে সাহিত্য
বাঁচতে গেলে আপনাকে বাজার করতেই হবে, সে আপনি মাঝ সমুদ্রেই যান আর মঙ্গলগ্রহেই যান। বাজার না করলে আপনি নিশ্চয় হাওয়া খেয়ে বাঁচতে পারবেন না। আমাদের সক্রেটিস চা খানায় একজন সদস্য আছেন তিনি খেতে যেমন ভালো বাসেন তেমনি বাজারও করেন খুব রসিয়ে রসিয়ে। ওনাকে কেউ পেটুক বললে খুব খুশি হন। শ্রদ্ধেয় সুকুমার রায় তাঁর কবিতায় বলেছেন, ‘খাদ্যাখাদ্য ভেদ নাই ব্রাক্ষণের সে তেজ নাই’!
তা উনি পৈতাধারী ভট্টাচার্য ব্রাক্ষণ বটে আর সত্যিই ওনার খাদ্যাখাদ্য ভেদ নাই, উনি একেবারে যাকে বলে পারফেক্ট খাদক, খিদে একেবারে সহ্য করতে পারেন না। খাবার ব্যাপারে উনি কোনো রকম বাছবিচার করেন না। উনি একজন দরদী শিক্ষক, গ্রামের একটা হাইস্কুলে পড়ান। ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে বসে মিড ডে মিল খান। এতে ছাত্র-ছাত্রীরা খুব উৎসাহ পায়। ওনার নাম সত্যানন্দ ভট্টাচার্য। তা ভট্টাচার্যবাবু কোথায় কোথায় ভালো আর নতুন কোনো খাবারের খোঁজ পেলে সেখানে একবার যাবেনি-ই। সেই রকমই একবার জামালদহে মিষ্টি আর মিষ্টি দই খেতে গিয়ে ঘোর বিপদে পড়েছিলেন। তা সেই বিপদের কথা ওনার মুখ থেকেই শোনা যাক।
‘আমি স্কুটি হাঁকিয়ে স্কুল থেকে জামালদহ গেলাম সেই বিখ্যাত মিষ্টি আর দই খেতে। দই-মিষ্টি খাওয়ার পর ভাবলাম এখানকার মন্দিরের ভোগ নাকি খুবই উপাদেয়। তা ভাবলাম এখানে ভোগ খেতে পয়সা লাগেনা। আর খিদেও পেয়েছে। গুটি গুটি পায়ে মন্দিরের উঠোনে পা রাখতেই দেখি আমাকে দেখে মন্দিরেরএকজন শিষ্য তড়িঘড়ি করে আমার সামনে এসে বলল, যাক স্বয়ং ঠাকুর আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। এখনি আপনার দীক্ষা হবে আপনি আমার সাথে আসুন।
‘আমি বললাম, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে,আমি ভোগ খেতে এসেছি।
‘উনি বললেন, নিশ্চয় নিশ্চয়, আপনার দীক্ষা হয়ে গেলেই আপনি মনের মতো ভোগ খাবেন।
‘আমি বললাম, আমি তো দীক্ষা নিতে আসিনি আর আমার তো শ্রীচরণ বাবার দীক্ষা নেওয়া আছে। দীক্ষা নেওয়া থাকলে আর দীক্ষা নেওয়া যায় না। উনি আমার কোনো কথা শুনলেন না। আমাকে হিড় হিড় করে টানতে টানতে মন্দিরের ভেতরে ঢুকে সুন্দর একটা আসনে বসিয়ে দিলেন।
‘আর নিজে আমার সামনের আসনে বসলেন।
‘বুঝলাম সব আয়োজন আগের থেকেই করা আছে।
‘তিনি বললেন, এবার চোখ বন্ধ করুন, আমি মন্ত্র বলব আপনি আমার সাথে সাথে মন্ত্র বলবেন।
‘আমি দেখলাম অনুনয়-বিনয় করে তো হবে না, এ ব্যাটা তো আমাকে দীক্ষা নিইয়েই ছাড়বে আর বলবে এটা খাওয়া নিষিদ্ধ, ওটা খাওয়া নিষিদ্ধ। আর খাওয়ার ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা আমি মানতে রাজি নই। তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম কড়া হতে হবে, তাই গর্জন করে বললাম , তবে রে শালা আজ তোকে মেরেই ফেলব! বলে উঠে দাঁড়িয়ে পাশেই রাখা বটি হাতে নিয়ে মাথার ওপর বন্ বন্ করে ঘুরিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেললাম। উনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দূরে বটির দিকে তাকাতেই আমি দৌড়ে বাইরে রাখা স্কুটি নিয়ে পগার পার। সোজা বাড়িতে এসে থামলাম।’
এ হেন সত্যানন্দবাবুর সাথে গতকাল দিনবাজারে সব্জির দোকানে দেখা। দুইহাত ভর্তি বাজার। আমি তখন ঢেঁড়স বাচছিলাম। আমাকে দেখেই বললেন 'আরে দাদা আপনি এখানে বাজার করতে এসেছেন! আপনি তো স্টেশন বাজারে বাজার করেন! তা ব্যাপার কী?
আমার আর ব্যাপার বলার সময় হলো না, দেখি বাজারের ভেতর থেকে হন্তদন্ত হয়ে পাকড়াশিবাবু ছুটে আসছেন। আমাকে দেখেই বললেন, ‘শিগগির গা ঢাকা দেন! ভূতুমবাবু , মঙ্গলময় লাই এখানেও হানা দিয়েছে!’
পাকড়াশিবাবুর আতঙ্কিত মুখ দেখে সত্যানন্দবাবু অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মঙ্গলময় লাই কে?’
আমার আর উত্তর দেওয়া হলো না। মঙ্গলময়বাবু এসে হাজির। আমাকে দেখেই বললেন, ‘আরে ভুতুমবাবু আপনি এখানে! বেশ ভালোই হলো। পাকড়াশিবাবুকে ডিম কিনতে দেখলাম, কিন্তু হঠাৎ কোথায় যে গেলেন!’
আমি বিপদ বুঝে সত্যানন্দবাবুকে দেখিয়ে বললাম, 'মঙ্গলময়বাবু, ইনি হলেন সত্যানন্দবাবু বিখ্যাত কবি এবং ভ্রমণ কাহিনী লেখক। আর ইনি হলেন মঙ্গলময় লাই মহাশয়।' চারুকলা প্রেসের মালিক এবং গিরিশিরা পত্রিকার সম্পাদক।’
মঙ্গলময়বাবু গদ গদ হয়ে সত্যানন্দবাবুকে নমস্কার করে বললেন, ‘হেঁ হেঁ আমার কথা তো শুনলেন। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগল। আপনি অবশ্যই আপনার কবিতা আর ভ্রমণ কাহিনী আমার পত্রিকায় অবশ্যই পাঠাবেন, তার পর একসাথে কবিতা আর ভ্রমণ কাহিনী মিলিয়ে মোটা করে বই বের করব। একটা কবিতা, একটা ভ্রমণ কাহিনী এইভাবে পরপর সাজিয়ে বের করব। বেশ অভিনব ব্যাপার হবে। প্রকাশনী জগতে হই চই পড়ে যাবে মশাই! দাম হবে তিনশো ষাট টাকা, টুয়েলভ পার্শেণ্ট ডিসকাউন্ট থাকবে।’
বলেই তিনখানা বই ওনার মাছের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তিনটা বইয়ের দাম দুশো ষাট টাকা … হেঁ হেঁ!’
ওদের কথা বলার মাঝখানে আমি সুড়ুৎ করে সরে পড়লাম। পাকড়াশিবাবু আগেই উধাও হয়ে গেছেন।
আমি চুপিচুপি বেশ খানিকটা এগিয়ে যেতেই বাঁ দিক থেকে চাপা গলায় ডাক শুনতে পেলাম, 'ভুতুমবাবু, ও ভুতুমবাবু এই যে এদিকে চা'য়ের দোকানে!’
আমি বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি পাকড়াশিবাবু দোকানের এক কোনায় বসে চা পান করছেন। আমি তাড়াতাড়ি দোকানে ঢুকে পাকড়াশিবাবুর পাশে বসলাম। পাকড়াশিবাবু চা বললেন। চা পান করতে করতে দেখলাম বেশ বেড়ে জায়গা বেছেছেন তিনি। চট করে কেউ বুঝতে পারবে না আমরা এখানে আছি।
পাকড়াশিবাবু বেশ চাপা গলায় বললটি, ‘সাংঘাতিক লোক মশাই এই মঙ্গলময় লাই। গত রোববার বিকেলে খোঁজ করতে করতে ঠিক আমার বাড়িতে এসে হাজির। বলে কিনা আগামী পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে আমাকে কবি হিসেবে স্বীকৃতি আর সম্বর্ধনা দেবে!
‘ওনার প্রেসের ছাদে সব আয়োজন করেছেন। সব 'এ' গ্রেড কবিরা আসবেন। ঐ দিনই নাকি কবি-লেখকদের নিয়ে লবি তৈরি করবেন। লবি না থাকলে নাকি জাতে ওঠা যায় না। অনেক কবিই ঘটা করে নিজেদের 'এ'গ্রেড কবি বলেন। তারা আবার অন্যান্যদের 'বি'গ্রেড, ‘সি'গ্রেড হিসেবে তুলনা করেন। সেই হিসেবে লবি উপ-লবি পাড়ায় পাড়ায় আছে। উনি সরাসরি আমাকে 'এ'গ্রেড কবিতে প্রতিষ্ঠিত করবেন। বললেন, আগে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন পরে কবিতা লিখবেন! শুনে তো আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার উপক্রম হয়ে গিয়েছিল ভুতুমবাবু! উনি আবার আমাকে ওনার লেখা কবিতা শোনালেন। কবিতাটা এই রকম-
আকাশ থেকে পড়ল মেঘ
তখনি আমার পাইল বেগ,
জলায় ডাকিল সোনার ভেক
থামিয়া গেল আমার বেগ।
‘বুঝুন ব্যাপারটা! আমি ওনাকে বারবার বললাম আমাকে এইসব ব্যাপারে জড়াবেন না, উনি আমার কোনো কথাই শুনতে রাজি নন। আমাকে ঠিক ঠাক কব্জা করতে না পেরে মোক্ষম চাল চাললো মশাই!
‘আমার গিন্নিকে কী বলল জানেন?
‘বলল, পাকড়াশিবাবু যদি একটু কবিতা, গল্প লেখেন তাহলে আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি ছ' মাসের মধ্যে আপনার গলায় পঞ্চাশ গ্রামের সীতাহার শোভা পাবে!
‘ব্যাস! আমার পুরো চৌকি উল্টে গেল। আমার আর রাজি না হয়ে উপায় রইলো না। অগত্যা আমি গিয়েছিলাম, তবে মেকআপ করে। আর লাইবাবুকে বললাম, আমার নাম কিন্তু এখন ভৈরব তালুকদার, কামিং ফ্রম বক্সীরহাট। আমার আসল পরিচয় যেন কেউ জানতি না পারে। তা না হলে আমিও আপনার গিন্নিকে গিয়ে বলব যে, আপনি প্রেমের কবিতা লেখেন আর গয়না কিনে বর্ণালীকে দেন।
‘লাইবাবুর মুখ দিয়ে বেরোলো, ‘হোঁকৎ! বর্ণালীটা কে?’
‘বুঝলেন ভুতূমবাবু, আমি আর মঙ্গলময় লাইয়ের মুখোমুখি হতে চাই না।’
বলে পাকড়াশিবাবু একচুমুকে চা'য়ের কাপটা খালি করে চুপি চুপি বেরিয়ে গেলেন।
আনন্দময় লেখা
ReplyDeleteফাটাফাটি!
ReplyDeleteদারুণ!এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম।চরিত্রগুলো চেনা চেনা মনে হচ্ছে যেন...
ReplyDeleteবাহ বাহ! সবেগে পড়ার মতো! রান্না না হোক, বাজার পর্বেই জম্পেশ স্বাদ!
ReplyDelete