সম্পাদকীয়
নমঃ
প্রতি বছর রবি ঠাকুরের জন্মদিন এলে যে কয়েকটা কথা ঘুরেফিরে আসে তার অন্যতম হলোঃ রবীন্দ্রনাথ কি বছরে একদিনই? কথাটার মধ্যে যতটা যুক্তি আছে তার চাইতেও বেশি আছে আবেগ। কালগত ব্যবধানে অনেক কিছুই ফিকে হয়ে আসে। রবি ঠাকুরের মৃত্যুর আশি বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর এই ব্যবধান আমরা অস্বীকার করতে পারি না। বাঙালির কাছে তিনি কখনোই পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবেন না, কিন্তু তিনি আর আগের মত পঠিতও হবেন না। নিয়ম করে রবীন্দ্রনাথের গান শোনেন এমন লোকের সংখ্যা বাঙলায় কমে যায় নি, কিন্তু নিয়ম করে তাঁর কবিতা পড়েন এমন পাঠকের সংখ্যা আজ অতি অল্পই।
পেশাগত দায়বদ্ধতা, সিলেবাস ইত্যাদির বাইরে রবীন্দ্রনাথের কবিতাই শুধু নয়, অন্যান্য রচনাও কতটা পঠিত হয় সে বিষয়ে সন্দেহ অমূলক নয়। হয় তো এটাই বাস্তব। তিনি মূখ্যত বেঁচে আছেন সুরযুক্ত কবিতাগুলির মধ্যে যা রবীন্দ্রসঙ্গীত নামে পরিচিত। কিন্তু সুর আর তালকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতার আকর্ষণ ক্রমশঃ কমে আসছে। এটা কিন্তু হতাশার কথা নয়। আধুনিক কবিতা মুক্তির সন্ধানে ছন্দকে ত্যাগ করার চেষ্টা করেছে, অন্ততঃ ছন্দ-মিলের গঠন সে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে সচেতন ভাবেই। প্রতিদিনের জড়-বাস্তব পৃথিবীর তুচ্ছ সুখ-দুঃখকে গ্রহণ করেছে কবিতায়। কোন অতীন্দ্রিয় পরম শক্তির প্রতি তাঁদের বিশ্বাস আর আগের মত অগাধ নয়।
এইখানেই রবি ঠাকুরের কবিতা, সুরকে বাদ দিয়ে গ্রহণ করায় একটু সমস্যা থাকে। তাঁর প্রেমের কবিতার কোন কোন লাইন এখনো প্রেমিকার উদ্দেশে পাঠান যায়, কিন্তু আজকের প্রেমিক-প্রেমিকারা কবিতা পড়তে চাইলে রবীন্দ্রনাথে তৃপ্তি পাবেন না। বিক্ষিপ্তভাবে তাঁর অনুপম গদ্যের কোন অংশ আমাদের মনের কথা বলে দিতেই পারে, তাঁর কথা সাহিত্যের কোন নতুন চিত্ররূপ বা নাট্যরূপ আমাদের আকৃষ্ট করতেই পারে, কিন্তু সব মিলিয়ে কালের ব্যবধানে তিনি কিছুটা দূরে সরেই গেছেন। এটা কোন খারাপ জিনিস নয়। ইংরেজরাও সেক্সপীয়র থেকে অনেক দূরে থাকেন, তাঁকে ভুলে যায় নি।
আমরাও রবীন্দ্রনাথকে ভুলব না। কিন্তু নব-নব সৃষ্টির আবির্ভাবের কারণে তাঁকে কিছুটা সরে যেতেই হবে ধীরে ধীরে। বাকি রইল তাঁকে পুজো করা। এটা ভারতীয় জনজীবনে নতুন কিছু নয়। যাকে ভালো লাগে তাঁর পুজো করাটা আমাদের বহুকালের ঐতিহ্য। রবীন্দ্র সাহিত্য একটি বিশেষ শ্রেণীতেই পঠিত হয়েছে। অতি সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ঠাকুর হয়ে গেছেন। এইভাবেই তিনি বিরাট জনতার কাছে কেবল একটি ‘নাম’ হয়ে যাবেন। সেক্সপীয়রের মত তিনিও হয় উঠবেন বিশেষজ্ঞের বিষয়। এরপরেও কেউ যদি ভালোবেসে পড়তে চান তাঁকে, উপকৃত হবেন নিঃসন্দেহে।
Comments
Post a Comment