কিতাব-ই-স্তান: ফকিরগঞ্জের লোকজন
ফকিরগঞ্জের লোকজন ও ফকিরগঞ্জের লেখক
ছোটগল্প রচনা করা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় শিল্পকর্ম, অন্তত আমার মতে। বাংলা সাহিত্যের হাতে পড়ে সেই ছোটগল্প যে জাদু দেখিয়েছে, তা বিশ্ববন্দিত। যার নজির গত একশো বছরের ছোটগল্পগুলি।
এই মূহুর্তে বাংলা ভাষায় ছোটগল্পের বই খুব বেশি বিক্রি হয় না, এটা আমি দেখেছি। লোকে যেভাবে বিপুল আয়তনের উপন্যাস, থ্রিলার পড়তে পছন্দ করে, ছোটগল্প অতটাও করে না। ছোটগল্পের স্থান যেন কবিতার মতোই। বিন্দুতে সিন্ধু, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ সমুদ্র দেখতেই বেশি ভালোবাসে। এক বিন্দু জলে তাঁর আশ মেটে না। সরাসরি বই আকারে প্রকাশ পায় উপন্যাস কিংবা থ্রিলারধর্মী রচনাই। সেক্ষেত্রে ছোটগল্পকে বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিতে হয় সংবাদ পত্রের সাহিত্য পৃষ্ঠা বা ম্যাগাজিনের। লিটিল ম্যাগাজিন গুলিও ছোটগল্পকে প্রশ্রয় দেয়। এভাবেই ছোটগল্পের বেঁচেবর্তে থাকা, স্বল্প কিছু রসিক পাঠক নিয়ে।
উপরের সমস্ত গৌরচন্দ্রিকার মূল কারণই হলো, একটি ছোটগল্পের বই নিয়ে আমার সামান্য পাঠানুভব ব্যক্ত করা। বইটির নাম 'ফকিরগঞ্জের লোকজন'। লেখক সৌগত ভট্টাচার্য।
বইটিতে বারোটি ছোটগল্প রয়েছে। প্রতিটি গল্পই জলপাইগুড়ি, সুদূর অতীতে যার নাম ছিল ফকিরগঞ্জ, সেখানকার লোকজনের জীবন নির্ভর। বইটিতে রিপ্রেজেন্ট করা হয়েছে সেইসব সাধারণ, মাটির কাছাকাছি মানুষদের, যারা কখনওই সাহিত্যের চরিত্র হতে পারে না বলে আমাদের ধারণা। কিন্তু লেখক নিজস্ব ডিএসেলার চোখ দিয়ে দেখতে পেয়েছেন তাদেরই।
একটা একশো পাতার উপন্যাস একবারে পড়ে শেষ করে দেওয়া যায়, কিন্তু মাত্র ৮৬ পাতার মধ্যে যদি বারোটি ছোটগল্প থাকে, তাহলে বারো বার লাগে। একটানা এই বই পড়া যাবে না। কারণ একটা গল্প পড়ার পরই আপনার মন চাইবে গল্পের সেই অভূতপূর্ব অনুভূতিটাকে জিইয়ে রাখি। এটাই, প্রকৃতপ্রস্তাবে, ছোটগল্পের শিল্প। আপনি যদি না'ই ভাবেন কিছুক্ষণ, আপনার ভাবনার জন্য যদি জায়গা না'ই রাখা থাকে, তবে আর কেন পড়বেন ছোটগল্প! বলাই বাহুল্য ফকিরগঞ্জের লোকজনেরা আপনার মুগ্ধতা অর্জন করবে। আপনাকে ভাবা প্র্যাকটিস করতেও সাহায্য করবে।
প্রথম গল্পটির নাম পোড়া মাটির দেশ। যে গল্প, আমার পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, কবিতাই পড়ছি। পুকুরের একেক অংশের জলে কীভাবে শহরের একেক অংশ প্রতিবিম্বিত হয়, তা ইঁটভাটার ফকিরচাঁদের চোখেই আপনাকে দেখতে হবে। সে'ই ফকির, যার 'চটি পরলে নিজেকে উঁচা উঁচা লাগে'। এক অদ্ভুত বিষণ্নতা আছে। কিন্তু সেটা আপনি উপভোগ করবেন।
'পোড়া মাটির দেশ' গল্পের পর থেকে যে গল্পগুলি আছে, সেগুলো, হিসেব মতো ঐ গল্পের টেম্পোর সঙ্গে যায় না। এগুলো প্রতিটিই ছোটগল্পের শর্ত পালন করেছে সঠিকভাবে। এগুলো গল্পই। কবিতার আস্বাদ পাবেন না সেভাবে।
বাংলা ভাষার প্রায় প্রতিটি লেখকই কোনো না কোনো সময়ে ছোটগল্প রচনা করেছেন। কিন্তু ছোটগল্পের জন্যই আমরা কোনো লেখককে মনে রেখেছি, এমন উদাহরণ একেবারেই সীমিত। এক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে, আমি সৌগত ভট্টাচার্যকে একজন ছোটগল্পকার হিসেবেই মনে রাখব। এটি তাঁর প্রথম বই। আর প্রথম বইয়েই তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, তিনি এলেবেলে খেলোয়াড় নন। টেস্ট ম্যাচের প্লেয়ার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হলো, সৌগত ভট্টাচার্য'র একটা নিজস্ব গদ্যরীতি আছে। বাক্যগঠন অত্যন্ত পরিশীলিত। কোনো বাড়তি কথা নেই। মেদ নেই। কত অল্প কথায় অনেকটা কথা বুঝিয়ে দেওয়া যায়, তা রীতিমতো শেখবার। কথনভঙ্গির মধ্যেই ধরা পড়বে মৌলিকতা। কোনো গল্পই আমার খারাপ লাগেনি। দুয়েকটা গল্পে প্রবেশ করতে খানিক সমস্যা হয়েছে, একথা অস্বীকার করব না, কিন্তু যখন ঢুকে পড়তে পেরেছি, তখন লেখক আমাকে লেখার গভীরতায় পৌঁছে দিয়েছেন কাহিনির চমৎকার বুননে। বিষয় নির্বাচনে।
ফকিরগঞ্জে শুধু চা বাগানের বড় বড় অফিস আর শপিংমলই থাকে না, থাকে বিয়েবাড়ির সানাইবাদক, থাকে ভাগ্য পরিবর্তনকারী আংটি বিক্রেতা, লটারির টিকিটওয়ালা, দর্জি, ঘড়ির দোকানদার, বন্দুকের দোকানী, খেলনা নির্মাতা, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী, তিস্তায় পরিযায়ী পাখি দেখিয়ে আনা নৌকার মাঝি এবং সর্বোপরি পাগল। হ্যাঁ, এরাই ফকিরগঞ্জের লোকজন। এদেরও জীবন আছে, আর জীবন থাকলে তাতে অবশ্যই থাকবে সুখ এবং দুঃখ। এই সুখ ও দুঃখের গল্পই লেখক লিখেছেন এই পাতলা, হলুদ রঙের মলাট দেওয়া বইটি জুড়ে। যদিও বইটির প্রচ্ছদ আমার পছন্দ হয়নি, তবে প্রচ্ছদে কীইবা যায় আসে!
আমি নিজে একজন ফকিরগঞ্জের মানুষ। তবুও এত গভীরভাবে নিজের মাতৃভূমির লোকজনের দিকে তাকানো হয়নি কখনও। লেখক সেই দেখার সুযোগ করে দিলেন, চোখও খুলে দিলেন। আর এইজন্যই ছোটগল্প সাহিত্যের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট শিল্প। সৌগত ভট্টাচার্য সেই শিল্পের আধুনিক রূপকার।
অজস্র বইয়ের মাঝে, এই বইটি অনেকদিন মনে থাকার মতো একটি পাঠ অভিজ্ঞতা দিলো। লেখক এবং বইটির প্রকাশক, যারা ছোটগল্পের চর্চা অব্যাহত রাখতে চান, তাদের ধন্যবাদ। প্রতিটি গল্প বাংলা সাহিত্যের সচেতন পাঠকের মনে দাগ কাটবে বলেই আমার বিশ্বাস।
ফকিরগঞ্জের লোকজন। সৌগত ভট্টাচার্য। প্রকাশকঃ আপনপাঠ। প্রথম প্রকাশঃ ২০২২। মূল্যঃ ১৩৫টাকা।
রঙ্গন রায়
অনন্য স্বাদের সব গল্প
ReplyDeleteভালো লিখেছিস
ReplyDelete