বিশেষ রচনা: শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়-এর 'বাজার সফর সমগ্র'
এভাবেও ভালোবেসে ফেলা যায়
সত্যম ভট্টাচার্য
শীতকালের ছুটির দিনে দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে রোদে খানিক শরীর গরম করার জন্য আমরা বারান্দায় বসতাম। নরম সোনালী ওম ওম রোদ তেরছাভাবে তখন যেন ঠিক আমাদের জন্যই সেখানে এসে পড়তো। বাবা তাতে পিঠ দিয়ে পেপার নিয়ে চেয়ারে বসতেন। নিচে আমি আর মা উলকাটা নিয়ে মাদুরে। হাতে হাতে ঘুরে বেড়াতো দার্জিলিং বা ভুটান পাহাড় থেকে নেমে আসা ফ্রেশ কমলালেবু। ওদিকে হয় তখন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন থেকে রেডিওতে গমগমে গলায় ডার্বির কমেন্ট্রি ভেসে আসছে অথবা ইডেন গার্ডেন থেকে উত্তাল জনসমুদ্রের আওয়াজ। কৃশানু-বিকাশ জুটি হয়তো সেইসময় যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ফুল ফোটাচ্ছেন। বা হলুদ বিকেলে শচীন নামছেন ব্যাট করতে অথবা অবিস্মরণীয় ভাবে দ্রাবিড়-লক্ষণ জুটি আটকে দিচ্ছেন অষ্ট্রেলিয়াকে।
এই যে ছোটবেলার গল্প করতে গিয়ে প্রথমেই বলেছি ‘খাওয়াদাওয়া’ কথাটি তার মানে ইতিমধ্যেই একটি জম্পেশ খাওয়াদাওয়া-র পর্ব সমাধা হয়েছে। দিনটি রোববার হলে বাড়িতে হয়েছে চমৎকার পাঠা বা খাসীর মাংসের ঝোল। খাওয়া হয়ে যাবার পরেও তার ম ম করা সুঘ্রাণ ঘুরে বেড়াচ্ছে বাড়িময়। এখন বড় হবার পর যে প্রশ্নটা মাথায় আসতো যে বাবারা কি মানসচক্ষে দেখতে পেতেন যে এমন মাধুর্যময় একটি বিকেল অভাবনীয় দুপুরের পর উপস্থিত হবে? আর সে কারণেই তারা সকাল থেকে ঠিক ঠিক জিনিসগুলো বাড়ি নিয়ে এসে উপস্থিত হতেন।
ওপরের করা প্রশ্নটি নিয়ে মনে অনেক দিন জিজ্ঞাসা থাকলেও সম্প্রতি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়ের ‘বাজার সফর সমগ্র’ বইটি পড়ার পর আর কোনো জিজ্ঞাসা নেই। হ্যাঁ, মানসচক্ষে তারা দেখতে পেতেন দুপুরের খাবার থালাটিকে এবং হয়তো তার পরের ঘটনাবলীকেও। দেখতেন ধবধবে সাদা ভাতের সাথে সেখানে সাজানো আছে কি কি পদ। আর সেই জন্যই সকাল থেকে ওত নিপুণভাবে একের পর এক জিনিস বাজার থেকে বাড়ি নিয়ে আসতেন। গনগনে কয়লার আঁচে রান্না করতে করতে মায়ের মুখ লাল হয়ে উঠলেও তাতে হাসিটি ধরা থাকতো সবসময়ের জন্য। আর শাড়ির আঁচলে লেগে থাকতো হাতের হলুদ মোছার দাগ।
জীবন আসলে এক বেঁধে বেঁধে থাকারই অপর নাম। আর এই যে বললাম মানসচক্ষে দেখতে পাবার ব্যাপারটি, বাবু শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয় তার বাজার সফর সমগ্রে তা একদম হাতে কলমে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। সে কারণেই আমি হয়তো প্রথম বাজারে গিয়েছি বাবার ইহলোক ত্যাগের পর। কারণ শ্যামলের কথা অনুযায়ী বাজার তো আসলে একটি উপন্যাস। তার এত এত চরিত্র-তাদের ঘরবাড়ি-সেখান থেকে প্রতি সকালে তাদের উঠে আসা আর নির্দিষ্ট জায়গাটিতে বসে পরম মমতায় সংগ্রহ করা জিনিসগুলি ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়া-এই বিশাল আখ্যানের কে না অংশ হয়ে উঠতে চায়। তাই বাবা হয়তো যতদিন পেরেছেন নিজেই বাজার করেছেন। আর তার পর আমি।
এবং এতদিন পর্যন্ত বাজারকে ভালোবেসে উঠতে পারিনি। কারণ পদে পদে ঠকেছি। মাংসওয়ালার কাছে থেকে পাঠা বা খাসীর মাংস কিনতে গিয়ে ভুল মাংস গছিয়েছে। বুঝতে পেরে তাতে মনে এমন কষ্ট পেয়েছি যে সেই মাংসওয়ালার কাছে আর কোনদিন যাইনি। শ্যামল কি ঠকেননি? বাজার সফর বইতেই তিনি লিখেছেন যে চালওয়ালী মাসীরা তার বাড়িতে মিথ্যা কথা বলে চাল বিক্রী করতে এসে কিভাবে তাকে ঠকিয়ে অনেক কম চাল দিয়ে গিয়েছে। তবু শ্যামল বাজারকে ভালোবাসা ছাড়েননি। একের পর এক বাজারে গিয়ে যেমন তিনি কথা বলেছেন সেখানকার গরীব শাকওয়ালী মাসীদের সাথে আবার আলাপ করেছেন সেখানকার দীর্ঘদিনের বিত্তশালী বনেদী মুদিখানার দোকানের মালিকের সাথেও। কিভাবে অল্প আয়েও হিসেব করে চললে সংসার চালানো যায় তা শ্যামল দেখিয়েছেন একদম নিম্ন আয়ের ব্যাক্তি যারা বাজারে টুকিটাকি জিনিস নিয়ে বসেন বা কিনতে আসেন তাদের সাথে কথা বলে। দেখিয়েছেন অনেক কিছুর সাথে জীবন এক যুদ্ধেরও নাম যা লড়ে যাওয়াতেই মজা। কত সামান্য টাকায় ৮-১০-১২ জনের সংসার এই বিক্রেতা মহিলারা হিসেব করে মনের জোরে টেনে চলেন তা ভাবলে সত্যিই জীবনকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে বৈকি। এমনকি কখোনো এদেরকে ভালোবেসে শ্যামল চলে গিয়েছেন বহু প্রত্যন্ত এলাকায়। হয়তো সুন্দরবন পেরিয়ে এদের কারুর কারুর বাড়িতে।
আবার একই সাথে শ্যামল দেখিয়েছেন যে এক একটি বাজার আসলে এক একটি ইতিহাস। কিসের ইতিহাস? সমসাময়িকতার ইতিহাস। গড়পড়তা আমরা কি সাধারণত কখোনো কোনো জায়গার বা বাজারের নাম নিয়ে ভাবি? জানার চেষ্টা করি বাজারের যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছি কত শত বছর আগে থেকে সেখানে বাজার বসা শুরু হয়েছিল? কেন সাধারণত বেশীরভাগ জায়গাতে বাজারের পাশেই থাকে দেহপসারিণীদের ঘর? মনে হয় না। শ্যামল ভেবেছেন। এবং একের পর এক কলকাতার বাজার সম্পর্কে বিভিন্ন অজানা তথ্য হাজির করেছেন এই বইতে। আমরা জানতে পেরেছি কিভাবে একদার ক্যাপ্টেন টলির নাম থেকেই গড়ে উঠেছে অধুনার টালিগঞ্জ। আর তাকে ঘিরেই বসেছে কত কত বাজার। সেখানে মিশে আছে কত কত মানুষের ঘাম রক্তের দাগ।
কোন বনধ বা ছুটির দিনে শুনশান বাজারে হয়তো ঢুকতে হয়েছে। অভিষ্ট জিনিসটির লক্ষ্যে এদিক ওদিক উঁকি দিতে হচ্ছে। কানে ভেসে আসছে কথাবার্তার আওয়াজ। হঠাত দেখা যাবে একটি নিভৃত কোণে কজন মিলে বসে তাস খেলছেন। পাশে আরো কজন মিলে গল্পগুজবে মশগুল। আসলে এরা সবাই বাজারের বিভিন্ন দোকানদার। তাই যতই দোকান বন্ধ থাকুক না কেন ঠিক ধীরে ধীরে সবাই উপস্থিত হয়েছেন আর বেছে নিয়েছেন মনের খোরাকটি। দেবেশ রায় যেমন তার তার তিস্তা সংক্রান্ত বইগুলিতে বারবার বলেছেন হাটুয়া মানষীদের কথা এরাও আসলে ঠিক তেমনি। আসলে হাট বা বাজার তো এক মায়াময় আখ্যানেরই পটভূমি। তাই চরিত্ররাও সেখানে সময়মতোই উপস্থিত হয়ে যান।
এই অব্দি পড়ে কেউ ভাবতেই পারেন যে বাজারের লোক তো বাজারে যাবেই। এতে এমন আর কি ব্যাপার আছে। কিন্তু বাজার সফর সমগ্রে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয় প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে বাজার, সাহিত্য এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীত- এই তিনটি বিষয়ই একই গ্রন্থিতে বাঁধা আর তার মূল তারটি হচ্ছে চুলচেরা হিসেব। সামান্য এদিক ওদিক হলেই যার কেটে যেতে পারে পুরো তাল। তাই যারা সাহিত্য বা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রকৃত সমঝদার তাদের হাতে বাজার হয়ে ওঠে আরো আরো কলা বা স্কিল দেখানোর জায়গা। ঠিক যেমন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসরে শুনেছি যত রাত বাড়ে মেহফিল তত জমে ওঠে। জায়গামতো লাগতে থাকে তাল সুর লয় ঠিক তেমনই মানসচক্ষে দেখা পদটির জন্য সকাল সকাল লাগসই সবজিতে ভরে উঠতে থাকে বাজারের ব্যাগ।
ছোটকালে যখন মোটরসাইকেল চালানোটিকে একটি বিশাল কম্ম বলে মনে করতাম তখন বড়দের কাছে বায়না করলেই তারা বলতেন আগে মোটরসাইকেলটিকে ডবল স্ট্যান্ড করো আর তারপর নামাও, তাহলেই চালানো শিখিয়ে দেবো। পারতাম না। ফলতঃ চালানোও শেখা হয়ে উঠতো না। এখন যখন পারি তখন আর কেউ সে কাজ করতে বলে না। আসলে মানুষ সময় হলে কিছু জিনিস এমনিই শিখে যায়। তাকে আর হাতে ধরে শেখানোর ব্যাপার থাকে না। তাই জীবনের এতগুলি বছর বাজারকে ভালো না বেসে কেটে গেলেও মনে হয় এই বই পড়ার পর অবশ্যই ভালোবাসতে শিখে যাবো। জীবন তো আসলে ভালোবাসারই আরেক নাম।
এক ঝাঁ ঝাঁ গরমের দুপুরে বর্তমানে ইহলোক ছেড়ে চলে যাওয়া এক জ্যাঠতুতো দাদাকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম কি গান চালাবো বল, সে বলেছিল চালা দেখি কি গান চালাতে পারিস তুই এখন। মাথায় ছিল না সেই দাদা নিজে যেমন তবলাবাদক আবার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একজন বড় সমঝদার। চালানোর সাথে সাথেই ও বলে উঠেছিল-বন্ধ কর বন্ধ কর। জিজ্ঞেস করাতে যা বলেছিল তার মোদ্দা কথা সময় বুঝে গান শোনার ব্যাপার আছে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আজো বুঝি না। কিন্তু এটুকু এখন বুঝি সন্ধ্যের ভালো লাগা গান সকালে ভালো লাগে না বা তার উল্টোটাও। খাওয়া দাওয়ায় ঠিক তেমনিই যেন। বাজার সফর পড়তে পড়তে বুঝতে পারি ঋতু-সময়-তাপমাত্রা এই সব কিছুর সাথে খাওয়া দাওয়াও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, ঠিক যেমন সঙ্গীত বা পোশাক। আর এটা সব থেকে ভালো বোঝেন ব্যাপারীরা। তাই তো তারা সঠিক সময়ে সঠিক জিনিসটি নিয়ে বাজারে উপস্থিত হন। যেমন ফাল্গুন চৈত্র আসলেই বাজারে চলে আসে নিমপাতা,সজনে বা গিমাশাক আবার গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষা আসলেই বাজারে চলে আসে ইলিশ মাছ,আর তার সাথে সাথেই উপস্থিত হয় কচুর শাক। এ যেন প্রকৃতির এক অদ্ভূত কম্বিনেশন, ইউনিক ন্যাচারাল রিদম।
‘দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে রঙিলা দালানের মাটি’ আর তাকে সেভাবেই গ্রহণ করতে হবে। এই পালটে যাওয়া পরিস্থিতিকে গ্রহণের আরেক নামই জীবন যাকে কতদিন আগে ডারউইন নাম দিয়ে গিয়েছেন যোগ্যতমের উদবর্তন। তাই আজ যখন দেখি উত্তরবঙ্গের চা শিল্পে অনেক বাগানের খারাপ অবস্থা, যুক্তির সাপেক্ষে মেনে নিতেই হয় যে এক না একদিন এ হবারই ছিলো। একটা সময় ছিল যখন চা বাগানের লোকেরা শহরে বাজার করতে আসলে অর্থের সাপেক্ষে শহরের লোকেদের ঈর্ষার কারণ হতেন। চা বাগানের সেই সুদিন বিগতপ্রায়। জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলন বা কর্তৃপক্ষের বাগানের প্রতি নজর না দেবার কারণে একের পর এক বাগান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব কিছুই তো বদলায়। যে বা যারা এই বদলের সাথে পাল্টাতে পারবে তারাই টিকে থাকবে। শ্যামল তার বাজার সফর বইটিতে অনেক আগেই এই বাস্তবটি দেখিয়েছেন যখন তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন হাওড়া বা হুগলীর এক একটি বাজারে। সেই সব বাজারে এক কালের রমরমা পাটকলের কর্মচারীরা পরিস্থিতির খাতিরে হয়তো বাজারে সবজি বিক্রী করতে বসেছেন বা অন্য কোন কাজ করছেন। বাজার এই দর্শনেরই সার্থক প্রতিফলন।
কিছু বছর আগে প্রতি রবিবার সকালে উঠে বসে থাকতাম প্রতিদিন খবরের কাগজের সাথে দেওয়া রোববার পত্রিকাটির জন্য। আর এই অপেক্ষার মূল কারণ হচ্ছে রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের রোববারের বাজার কলামটির জন্য। সেখানেই প্রথম জানতে পারি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই অবাক করা বাজার প্রীতির কথা। ততদিনে তার কেবলমাত্র সাধু কালাচাঁদ বা শাহজাদা দারাশুকো পড়েছি। সেই রোববার পত্রিকা থেকেই জানতে পারি আশ্চর্য মানুষ ছিলেন এই শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। একদিকে যেমন শাহাজাদা দারাশুকোর মতো ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখে রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পেয়েছেন সাহিত্য একাডেমি পুরষ্কার পেয়েছেন আবার এই মানুষটিই চাষবাস জানার জন্য কলকাতা থেকে ষাটের দশকে পাততাড়ি তুলে চলে গিয়েছিলেন চম্পাহাটি নামে কোথাও। ফিরে এসে কলকাতা শহরে বারবার তার বাসা বদল করেছেন। ঘুরে ঘুরে থেকেছেন উত্তর থেকে দক্ষিণে। চিনেছেন কলকাতার আনাচে কানাচের সব বাজার আর একই সাথে সেই বাজারের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিক্রেতাদের। আবার একই সাথে ঠিক সময়ে তাদের সমালোচনা করেছেন জিনিসপত্রের দাম নিয়ে কালোবাজারি করবার জন্য। আবার কত কম দামে সঠিক জিনিসটি পাওয়া যায় তার উদাহরণ তিনি দিয়েছেন এই বইয়েই। রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মার হাত থেকে একাডেমি পুরষ্কার নেবার সময় তিনি যে পাঞ্জাবিটি গায়ে দিয়ে গিয়েছিলেন সেটি যে তার স্ত্রী ইতি গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়া নিজের হাতে শিউলি ফুলের বোঁটা শুকিয়ে তা দিয়ে আসল বাসন্তী রঙ করে দিয়েছিলেন তা কি সহজেই না তিনি ব্যক্ত করেছেন এই বইতে। কারণ বাজারে সঠিক বাসন্তী রঙের পাঞ্জাবীর কাপড় নাকি সেই সময় পাওয়া যাচ্ছিল না। সেটি আনার জন্যই এত পরিশ্রম। আবার পাঞ্জাবি দুটি তৈরি হয়েছিল একটি ধুতিকে সমান ভাবে কেটে।
কত কত অজানা জিনিস উঠে এসেছে এই বইয়ের পাতায় পাতায়। যেমন মুঘল আমলে ভারতবর্ষে ফুলের এত সমাহার ছিল যে সব ধরণের ফুল থেকে একটি করে পাপড়ি নিয়ে ওজন করলে তার ওজন হত ছ মণ। আইন ই আকবরীতে আবুল ফজল লিখে গিয়েছেন এসব। আবার আমরা কি জানি ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সূচনা যার হাত ধরে সেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কবে কি কারণে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। শ্যামল আমাদের জানিয়েছেন ১৫৯৯ সালে ইংল্যান্ডে লঙ্কার উৎপাদন না হওয়াতে প্রাচ্য থেকে লঙ্কা আমদানির জন্য এই কোম্পানীর প্রতিষ্ঠা। যার ডাক নাম ছিল জন কোম্পানী। আবার হীরালাল চৌধুরীর নাম কজন বাঙালী জানে? অথচ মাছেভাতে বাঙালীকে মাছ যোগান দিতে কিন্তু কৃত্রিম উপায়ে বিশ্বে মাছ প্রজনন ইনিই উদ্ভাবন করেছিলেন। এরকমই নানা অজানা অথ্যে ভরে আছে বাজার সফর নামক এই আশ্চর্য বইটি।
এই গোটা পৃথিবী বা তার প্রকৃতি এক আশ্চর্য ছন্দের তারে বাঁধা। সেজন্যই তো ফাল্গুন-চৈত্র পেরুতে না পেরুতেই রসনা পরিতৃপ্তির জন্য বাজারে চলে আসতে থাকে একের পর এক আম। আবার গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষা নামলেই বাজারে চলে আসে ইলিশ। আবার দুর্গাপুজো পেরুলেই বাজার ভরে ফুলকপিরা যেন হাসতে থাকে। আজ যখন গোটা রাজ্য তথা দেশ ছেয়ে গিয়েছে স্বজনপোষণের চূড়ান্ত ঘৃণ্য উদাহরণে তখন আমের প্রসঙ্গে এক অদ্ভূত ন্যায়ের উদাহরণ বাজার সফর বই থেকে দেওয়া যাক। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের আম আসতো দাক্ষিণাত্যের বুরহানপুর দুর্গ থেকে। এবং নিয়ম ছিল যে এই আম কোথাও রাখা যাবে না। কারণ রাখলেই তাতে কালো দাগ ধরে যায় যা সম্রাটের বিলকুল না পসন্দ। আর এই পুরো ব্যাপারটির দায়িত্ব ছিল ঔরঙ্গজেবের ওপর। কিন্তু একবার আম এলো আর বাদশাহ তা খেতে বসে দেখলেন যে তাতে কালো দাগ ধরে গিয়েছে। ঔরঙ্গজেবকে দূরে দাক্ষিণাত্যে পানিশমেন্ট পোস্টিং দিয়ে দেওয়া হল।
এবারে আসা যাক ঠিক কোন জায়গায় এসে এই বই সাহিত্যরসোত্তীর্ণ হয়েছে এই প্রশ্নে। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় আজকাল পত্রিকায় এই কলমটি লিখতে শুরু করেছিলেন মার্চ,১৯৯৭ থেকে এবং সেপ্টেম্বর,২০০০ এই অব্দি কলামটি নিরমিত চলে। তাহলে এটি তো একটি প্রতিবেদনের সংকলন হয়েই থাকতে পারতো। কিন্তু যখনই শ্যামল নিমপাতাকে ডেকেছেন পাগলা ঘোড়া নামে, এমন ইমেজারি বা রূপক তো সাহিত্য ছাড়া অসম্ভব। আবার সুচরিতা হালদারের মতো প্রান্তিক জীবনের নারীরা যে পরম মমতায় এবং হিসেবে তাদের সংসার লালনপালন করে চলেছেন তাতে জীবনের যে ছবি ধরা পরেছে তা একমাত্র সাহিত্যই স্পর্শ করতে পারে। আবার গোপীনাথ নামে যে চা বিক্রেতা ক্রেতার মুখ দেখেই বলে দিতে পারেন সে কি রকমের চা খেতে চায় তা তো দীর্ঘ এক অবলোকনেরই ফল।
মাঝে মাঝে খারাপ লাগে যে মাত্র তিন চারটি জায়গা ছাড়া শ্যামলের এই সংকলনে উত্তরবঙ্গের প্রসঙ্গ আসেই নি। কলকাতার মতো তিনিও যদি এদিককার বাজার বা হাট নিয়ে লিখতেন তাহলে কত অজানা তথ্যই না আমাদের সামনে আসতো। অপেক্ষায় থাকি কেউ যদি এমন একটি কাজ করেন। জীবন তো এমন একটি চেয়ে থাকারই নামান্তর। আর ততক্ষণ বাবু শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাজার সফরের পাতা ওল্টাই। আরো যদি কোন কিছুকে ভালোবাসতে পারি। এ যাত্রায় যেমন বাজারকে ভালোবেসে ফেললাম।
ফোটোঃ লেখক
দারুণ লেখা
ReplyDelete